Saturday, April 25, 2009

এক ক্লিকেই বন্ধুত্ব?

‘ওয়ান ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট’। ক্লিক করলেন এড এস আ ফ্রেন্ড। এরপর? ছবিটা চেনা চেনা মনে হচ্ছে না? মনে সামান্য দ্বিধা? তŸু ‘এড’ বাটনটায় চাপ দিয়েই দিলেন? ব্যাস হয়ে গেল বন্ধু! পরিচয় জানা নেই? তাতে কি! লিস্টে যতদিন আছে, ততোদিন ‘ফ্রেন্ড’। তারপর শুরু হলো স্ট্যাটাসের ফুলঝুরি, বাহারি সব গ্র“পে জয়েন, কমেন্ট, কমেন্টের জবাবে ফের কমেন্ট। ছবি আপলোড করে তা আবার কাকে কাকে দেখাবেন, তাও ঠিক করে দেয়া যাচ্ছে (যাকে বলে ‘শেয়ারিং’)। এরপর আবার গণ্ডায় গণ্ডায় ভার্চুয়াল গিফট তো আছেই। এমনিতে হয়তো মাসে দুমাসে খবর নেয়া হয় না, কিন্তু মাউসের দুচারটে ক্লিক করে তার সঙ্গে অনায়াসে খাওয়া যাচ্ছে কফি (আসল নয়, ভার্চুয়াল)।

শুনতে বেশ জটিল মনে হলেও, এসবই এ যুগের ‘ফ্রেন্ডশিপ’। খোলাসা করতে গেলে, এটাই হচ্ছে এ কালের ‘সমাজ গড়ার নেটওয়ার্ক’। যেখানে বন্ধুত্ব শিখতে হলে আগে আপনাকে দক্ষ হতে হবে অনলাইনে। ফেসবুক একাউন্ট নেই! হায় হায়! জীবনের পনের আনাই মিছে! প্রযুক্তিতে আনাড়ি যারা, তারাও দেখা যায় কদিন পর একে ওকে বলে কয়ে একখানা একাউন্ট দাঁড় করিয়ে নিচ্ছে। এসব ছাড়া চলে নাকি!

কদিন পর অবশ্য সমস্যার বালাই নেই। ‘বন্ধু’রাই শিখিয়ে দেবে, কী করে অন্য বন্ধুদের তালিকায় যোগ করবেন। কী করে ‘ওয়াল’এ লিখে লিখে আড্ডা দেবেন, কী করে স্রেফ ক্লিক করে করে হরেক প্রতিবাদ, গ্র“প ও আন্দোলনে সামিল হবেন।

এসবের ফলে কী হবে? গুটিকয়েক বিশেষজ্ঞ অবশ্য কিছুদিন আগে বলেছিলেন, এসব ভার্চুয়াল নেটওয়ার্ক যতোবেশি দৃঢ় হবে, ততো একা হতে থাকবে ব্যক্তি। ততো বেশি একাকীত্ব ছেঁকে ধরবে, রক্তমাংসের মানুষটাকে।

আপাতদৃষ্টে এসব সামাজিক বন্ধন টাইপ প্রযুক্তি অনেকটা ফাঁদের মতো। অভ্যস্ত হয়ে গেলে এসব ছাড়া যেন চলবেই না। তদুপরি এসবের পক্ষে সাফাই গাওয়ার অস্ত্রেরও অভাব হয় না। পক্ষে দাবি একটাই, নিখরচায় যোগাযোগটা তো হচ্ছে! কিন্তু আসল বন্ধুত্বের নির্যাসটুকু কি ক্রমশ ম্রিয়মাণ হচ্ছে না? সমাজের দোহাই দিয়ে গুটিকয়েক ওয়েবসাইট আমাদের জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে নিচ্ছে না তো?

আমাদের এ উপমহাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো ভার্চুয়াল জগত সেভাবে উপনিবেশ না গড়লেও ইউরোপ-আমেরিকায় এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে কদাচিৎ ‘মিস’ করে। দরজায় নক করে সশরীরে হাজির হয়ে সারপ্রাইজ দেয়ার রীতিটা উঠেই গেছে বলা যায়।

নবীনরা তো নতুনকে সাগ্রহে নেবেই। তবে পুরনো প্রযুক্তিকে বাতিলের খাতায় ছুড়ে ফেলার আগেই যদি তারা ঐ অণুষঙ্গের প্রতি বিচিত্র এক মানসিক জালে আটকা পড়ে, তবে ওটাও নিত্যপ্রয়োজনীয় চাল-ডালের মতো হয়ে পড়বে। তখন ওসব ভার্চুয়াল ব্যাপারগুলো ছাড়া তাদের একটি দিনও চলবে না!

গড়পড়তায় ফেসবুকের সব ‘ফেস’ কিন্তু চেনামুুখ নয়। কিন্তু সেই অচেনা মুখগুলোও কোনো এক রহস্যময় সম্পর্কের জালে আটকে দেয় নবীন ব্যবহারকারীদের। এসব চেহারা থেকে জš§ নেয় এক ধরনের ‘অপ্রয়োজনীয় নস্টালজিয়া’। তৈরি হয় প্রযুক্তির জোর করে চাপিয়ে দেয়া এক অদ্ভুত বন্ধুত্ব!

বিপরীতে, সিরিয়াস প্রযুক্তিপ্রেমীদের দাবি একটাই, কম্যুনিকেশনের জন্য এরচেয়ে ভাল কিছু হতেই পারে না। কিন্তু এই যোগাযোগে আদৌ কতোটুকু ‘যোগ’ হচ্ছে? কতোটুকু ‘যুক্ত’ হওয়া যাচ্ছে? কিছু কিছু সেবার খাতিরে এ প্রশ্নগুলোও নিছক অহেতুক হয়ে পড়ে।

ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখা, ‘মন খারাপ’। তা দেখে কি আর সেই বন্ধুর চেহারায় ফুটে ওঠা কষ্টের ছাপ কিংবা চোখের বিষণœতার ছোঁয়া সম্ভব? শব্দ বুনে বুনে তৈরি একটা যুৎসই কমেন্ট কি কারো মন ভাল করতে পারে? কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যা হচ্ছে, এতোদিনকার বন্ধুর মন খারাপের সংবাদ পেয়ে স্রেফ একটা কমেন্ট জুড়েই দায় সারছে অনেকে। আগের মতো আর কাঁধে হাত রাখার সময় নেই? কিংবা পাশে খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার?

জীবনকে আরো ‘সহজ’ করতে গিয়ে এক জটিল গোলকধাঁধা তৈরি করছে না তো এসব স্যোসাল নেটওয়ার্কিং সাইট? বের হয়ে আসার সমাধান কিন্তু হাতের নাগালেই, একান্ত নিজের ভেতরকার অস্তিত্বটাকে ওয়েবসাইটের বাইরে এনে সবাইকে স্বকণ্ঠে জানিয়ে দিন আপনার ‘স্ট্যাটাস’। যারা মন দিয়ে শুনবে, আসল বন্ধু তারাই।