Saturday, April 25, 2009

দ্য ফেইসবুক

গল্পটা অনেক প্রাচীন। স্ত্রী আর দুই ছেলেকে নিয়ে সুখী পরিবার বাবার। সামান্য মাইনের চাকরি করেন তিনি, তবে চরিত্রের প্রয়োজনে খুব সৎ। কাজেই সংসারে অভাব-অনটনও নিত্যসঙ্গী। তাঁর দুই ছেলে গান গেয়ে গেয়ে স্কুলে যায় আর আসে। একদিন বড়লোক চৌধুরীর (যার একটি ফুটফুটে কন্যা আছে, বড় হয়ে নায়িকা হবে) রোষানলে পড়ে অন্যায়ের কাছে হার না মেনে তার পোষা গুন্ডার গুলি খেয়ে মারা যাবেন বাবা, বসতভিটায় দাউদাউ করে জ্বলতে থাকবে আগুন। ছোট ছেলেকে কোলে করে একদিকে ছুটে যাবেন মা, অন্যদিকে বড় ছেলে। হারিয়ে যাবে দুই ভাই। গল্পের শেষে অথবা মাঝামাঝিতে দুই ভাই-ই (এদের একজন নায়ক) তখন অনেক বড়। দেখা-সাক্ষাৎ হলেও পরিচয় নেই। মনের আনন্দে একদিন এক ভাই সেই ছোট্টবেলায় স্কুলে যাওয়ার পথে গাওয়া গানটি গেয়ে উঠবে আর অন্য ভাই সেটি শুনে দু-একবার ফ্লাশব্যাকে চলে যাবে আর বুঝতে পারবে এটাই তার হারিয়ে যাওয়া ভাই। তারপর দুর থেকে ‘ভা-ই-য়া’ বলে ছুটে এসে আলিঙ্গনাবদ্ধ হবে। আবহ সংগীতের সঙ্গে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে সংলাপ ছোড়াছুড়ি চলবে কিছুক্ষণ। বাংলা চলচ্চিত্রের এই যে দুর্দান্ত মিলন, এর মূলে রয়েছে একটি গান−‘সিগনেচার টিউন’।
আজ এই একুশ শতকে এসে ‘সিগনেচার টিউন’-এর কাজটা করে দেয় ‘ফেইসবুক’। স্কুল, কলেজের দস্যিপনার সাথী, ছোট্টবেলায় হারিয়ে যাওয়া চৌধুরীদের ফুটফুটে কন্যা আর হাঁটুবেলার বন্ধুদের আজকাল অনেকেই খুঁজে বেড়ান ফেইসবুকে।
ফেইসবুকের জন্ন ইতিহাসও কিন্তু সেই খোঁজাখুঁজিরই ইতিহাস। ২০০২ সালের কথা। হার্ভার্ড পড়ুয়া মার্ক জুকারবার্গ বেশ মনোযোগ দিয়েই সে সময় ব্লগ লিখতেন। ব্লগের বিষয়বস্তু ছিল এক বালিকা। কিন্তু মার্ক অচিরেই বুঝে গেলেন, শুধু ব্লগ লিখে কাজ হবে না, এমন একটা কিছু করতে হবে যা তাঁকে নিয়ে যাবে ওই বালিকার পরানের গহিনে। ২০০৩ সালে মার্ক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। খেয়ালের বশেই ‘ফেইসম্যাশ’ নামে তৈরি করলেন এমন একটি নেটওয়ার্ক যাতে হার্ভার্ডের একই বিভাগের শিক্ষার্থীরা তাদের নিজের ছবি রাখতে পারে আর সেই সব ছবিকে ভাসিয়ে দিতে পারে মন্তব্যের বন্যায়। এই ফেইসম্যাশ থেকে দ্য ফেইসবুক, সেখান থেকে শুধুই ফেইসবুক। গুগল, মাইক্রোসফটের ২০০, ৩০০ কোটি ডলারের হাতছানিকে উপেক্ষা করে শুধুই এগিয়ে চলার ইতিহাস তাঁর।
আরে, এফবিইং (ফেইসবুকিং) ছাড়া আজকাল স্নার্ট হওয়া যায় নাকি? তাই তো বাংলাদেশের কম্পিউটার আর মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা আজ যেন ফেইসবুক প্রজন্ন। এ প্রজন্েন আছে ছেলে বুড়ো খোকা সবাই। শিক্ষার্থী থেকে করপোরেট ব্যক্তিত্ব, শিল্পী-সাহিত্যিক, খ্যাত-অখ্যাত সবার যেন সমাবেশ এই ফেইসবুকে। নিজের শিরোনাম (স্ট্যাটাস) বার্তায় সেই প্রজন্েনর মনের ভাবনাটা পলকা কথায় ছড়িয়ে পড়ে ইউনিকোডের সুসজ্জিত বিন্যাসে। ঢাকায় বৃষ্টি হলে তাই হাজারটা স্ট্যাটাসে বৃষ্টিবন্দনা দেখে বহুদিন দেশ ছাড়া জার্মানিতে পড়তে যাওয়া ছেলেটি যখন স্ট্যাটাস দেয়, ‘আহা কত দিন ঝুম বৃষ্টি দেখি না’, সেই হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে একযোগে। কেন তার হাহাকার হয়ে ওঠে আমার হাহাকার? কারণ সে আমার ফেইসবুক বন্ধু। আমার, আপনার বন্ধু কজন এটা জিজ্ঞেস করলে চট করে বলে ফেলা বেশ মুশকিল, অনেকক্ষণ ধরে হাতের গিঁট গুনতে হবে। কিন্তু ফেইসবুকের কল্যাণে বন্ধু এখন গাণিতিক সংখ্যায় প্রকাশের বিষয়। কারও বা ৯৮ কারও বা ২৫৯৮। সবারই এক পরিচয়−ফেইসবুক বন্ধু। ফেইসবুকের হিসাবমতে গড়ে সবার বন্ধুসংখ্যা ১২০। আর শুধু ঢাকা শহরেই ফেইসবুকের সদস্য এক লাখ ২০ হাজারেরও বেশি।
আচ্ছা ঠিক আছে, নতুন বন্ধুতে আপনার খুব একটা আগ্রহ নেই। তাহলে কিসে আগ্রহ আপনার? নতুন ব্যবহারকারী হিসেবে ফেইসবুকে আপনি করবেনটা কী! মুখ ফুটে বলতে হবে না। মাউসের ক্লিকে শুধু খুঁজে নিন ৫২ হাজার প্রোগ্রাম থেকে আপনার পছন্দেরটি। আরে কত যে মজা সেখানে। ছোট্ট একটা উদাহরণ দিই। লাইভ অ্যাপ্লিকেশন নামে একটা প্রোগ্রাম দিয়ে পোষা প্রাণী পাওয়া যায়। উহু পোষ্য হিসেবে ছোট্ট হাতি গাবলু আর কুকুর গুল্লুকে শুধু শোকেসে রেখে দিলেই হবে না, নিয়মিত যত্ন-আত্তি নিতে হবে। যত্ন না নিলে, না খাওয়ালেই সপ্তাহ খানেকের ভেতরই পটল তুলবে সেগুলো।
বগুড়া মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বর্ষের ছাত্রী সুমির প্রিয় প্রোগ্রাম বিভিন্ন ধরনের কুইজ। সে কবে মারা যাবে, কবে তার বিয়ে হবে, বিয়ে হলে বাচ্চাকাচ্চা কয়টি হতে পারে−এসব দেখেই নাকি তার অনেক মজা লাগে। পাঁচটি অ্যাডজেকটিভ দিয়ে একজনকে ডেসক্রাইব করার ‘আই ডেসক্রাইব’ অনেক প্রিয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ুয়া রিনথির। কয়েক বাক্যেই একজন সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায় সেখানে। তবে সর্বসম্মতিক্রমে ফেইসবুকের সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো ‘স্ট্যাটাস’। ব্যক্তিজীবনে আপনার আশানুরূপ স্ট্যাটাস না থাকতে পারে। কিন্তু ফেইসবুকের দুনিয়ায় আপনি নিজেকে সাজাতে পারেন বিচিত্র স্ট্যাটাসে।
আনন্দ ছাড়া জীবন অর্থহীন, ফেইসবুকেরও একই মত। ফেইসবুকের প্রতি ক্লিকেই সিরিয়াস সব বিষয়ের পাশাপাশি ছড়িয়ে আছে রাশি রাশি আনন্দ। বেশ কয়েক মাস আগে নাট্যকার আনিসুল হক টেলিভিশনের জন্য লিখেছিলেন নাটক ফেইসবুক। তরুণ কবিদের কবিতায় ঢুকে যাচ্ছে ফেইসবুক, ফেইসবুকে লেখা হচ্ছে ফেইসবুককাব্য। এমনকি একজনের স্ট্যাটাসের একটি বাক্য ধরে একের পর এক বহুজন মিলে লিখে ফেলছেন বড়সড় কাব্য। এসব মিলিয়েই ফেইসবুক আমাদের দেশে শুধু ভার্চুয়াল দুনিয়ায় না থেকে ঢুকে পড়েছে শিল্প, সংস্কৃতি, কবিতা আর নাটকে।
যে ছবির অ্যালবাম এত দিন আলমারিবন্দী হয়ে ছিল, ফেইসবুকের কল্যাণে সেটা এখন প্রদর্শনী কক্ষে। অনেকে ছবিই তুলছেন ফেইসবুকে ‘আপ’ করবেন এই কথা মাথায় রেখে। সব ধরনের ছবিই তুলে ধরতে পারেন আপনি সেখানে−সিরিয়াস ফটোগ্রাফি, কোথাও ঘুরতে যাওয়ার ছবি অথবা নিছকই মজার ছবি। আর যদি ছবি না হয়ে ভিডিও হয়। চিন্তা নেই, তারও ব্যবস্থা আছে। প্রতি মাসে সাড়ে আট হাজার কোটি ছবির পাশাপাশি আট কোটি ভিডিও প্রকাশকরে ব্যবহারকারীরা।
বন্ধুদের জন্নদিন মনে করিয়ে দেবে ফেইসবুক। তিন দিন আগে থেকে জানাতে থাকবে কবে কার জন্নদিন। হালকার ওপর দিয়ে সারতে চাইলে ফেইসবুকের গিফট প্রোগ্রাম থেকেই পাঠিয়ে দিতে পারবেন ছোট্ট, সুন্দর একটা পুতুল। এই গিফটেরও আছে রকম ফের। ‘গ্রোয়িং গিফট’ থেকে পাঠানো উপহারগুলো দিন যাবে আর নিজ থেকেই বড় হতে থাকবে। মনে করুন কাউকে আপনি একটি বীজ উপহার পাঠালেন। কয়েক দিনের ভেতরই সেই বীজ গাছ হয়ে ফুল ফুটে সৌরভ ছড়াতে থাকবে বন্ধুর প্রোফাইলে। যে সময়টা আপনি অনলাইনে বসেছেন সে সময়ে কোন কোন বন্ধু অনলাইনে আছেতা যেমন
বাইরের আবহাওয়া এখন চরম গরম। সেই গরমকে মাথায় রেখে এসি না হোক চলুন একটু ফেইসবুকের ফ্যান ক্লাবের দুনিয়ায় একটু উঁকি মারি। কার কার ভক্ত আপনি? অমুকের অভিনয়ের তমুকের লেখার বা অমুক পণ্যের। হয়ে যান তাদের ফ্যান।
এবার একটু কাজের কথায় আসি।
সদ্য স্মাতক ইকবাল হোসেন। তিন বন্ধু মিলে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘রেসস্কেচ’ নামের একটি পরামর্শক সংস্থা। ফেইসবুকই তাঁদের অফিস, ভার্চুয়াল অফিস। সেখানে প্রতিষ্ঠানের নামে একটি গ্রুপ খুলে ‘ডিসকাশন ফোরাম’-এ আলোচনার মাধ্যমে চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের কর্মকান্ড। এই তো সেদিন একজনকে দেখা গেল লিখিত স্ট্যাটাসের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের জন্য লোক খুঁজছেন একজন। পণ্যের প্রচার থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সবই আছে ফেইসবুক দুনিয়ায়।
তাই তো সারা বিশ্বে ফেইসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা এখন ২০ কোটিরও বেশি। পরিসংখ্যান বলে ২০ কোটির মধ্যে তিন কোটি ব্যবহারকারীই মোবাইল ফোন থেকে ফেইসবুক ব্যবহার করছে। কাজের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, কাজকর্ম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এমন প্রশ্ন তুলে অনেক অফিস-আদালত ফেইসবুকের ব্যবহার বন্ধ করে রেখেছে। সেই সঙ্গে সিরিয়া, ইরানসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই ফেইসবুক ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও ফেইসবুক দুনিয়ায় প্রতিদিনই যুক্ত হচ্ছে হাজার হাজার নতুন ব্যবহারকারী। আরে যোগাযোগ আর আনন্দের এমন এক মাধ্যম থেকে কার সাধ্য মানুষকে দুরে রাখে?
সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: ফেইসবুকে আপনার আপ করা সব ছবি, ভিডিও বা লেখা সবই কিন্তু ফেইসবুকের সম্পত্তি। ফেইসবুক কর্তৃপক্ষ চাইলেই সেসব তাদের যেকোনো কাজে লাগাতে পারে। বিশ্বাস না হলে তাদের টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন অংশে আগেই একটু চোখ বুলিয়ে নিন। আর ফেইসবুকে কিন্তু রয়েছে অনেক ছদ্মবেশী, তাদের থেকেও সাবধান!

ফেইসবুকের সদস্য হবেন যেভাবে
ফেইসবুকের বন্ধু হতে হলে আপনার থাকতে হবে একটি কার্যকর ই-মেইল ঠিকানা। তারপর www.facebook.com ঠিকানার ওয়েবসাইটে ঢুকে সেই ই-মেইল ঠিকানা দিয়ে একটা পাসওয়ার্ড দিয়ে দিন। অনেকেই যে ভুলটা করে থাকে সেটা হলো ফেইসবুকের পাসওয়ার্ড হিসেবে নিজের ই-মেইল ঠিকানার পাসওয়ার্ডই দিয়ে দেয়। সেটার একদমই প্রয়োজন নেই, বাধ্যতামূলকও নয়। চাইলে আপনি ফেইসবুকের জন্য আলাদা একটা পাসওয়ার্ড দিতে পারেন এবং সেটাই অনেক বেশি নিরাপদ। এবার সার্চে গিয়ে আপনার বন্ধু-বান্ধবদের খুঁজে বের করে তাদের যোগ (অ্যাড) করুন আর নিজের মতো সাজিয়ে নিন নিজের অ্যাকাউন্ট।

No comments: