Saturday, April 25, 2009

‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায়…’

এটা রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘দুই বিঘা জমি’ নামের একটি কবিতার বাক্যের অংশ। পুরো বাক্যটি হচ্ছে: ‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি,/রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।’ কবিতাটি লেখার পেছনে একটি ঘটনা আছে। রবীন্দ্রনাথ তখন শিলাইদহে তার পৈতৃক কুঠিবাড়িতে আশপাশের জমিদারির দেখাশোনা করছেন। খবর পেলেন তার এক নায়েব একজন গরিব প্রজার জমি জোরদখল করেছে। মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ জমিদার রবীন্দ্রনাথের ঊর্ধ্বে উঠে ওই প্রতিবাদ-কবিতা তাৎক্ষণিক রচনা করলেন। তবে আমরা কেন মধ্যবিত্ত মানসিকতার ঊর্ধ্বে উঠে অতিরিক্ত সম্পত্তি ভোগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে পারবো না? বাংলাদেশের সংবিধানে তো এটা স্পষ্ট করাই আছে ২০(২) অনুচ্ছেদেÑ ‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসেবে কোন ব্যক্তি অনুর্পাজিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না…।’

হ্যাঁ, আপনার অনুমান সঠিক প্রিয় পাঠক, সেনানিবাসে বিএনপি চেয়ারপারসনের বাসার লিজ বাতিলের ঘটনাটি হচ্ছে আমার আজকের লেখার বিষয়। এ ঘটনাটি কখনো আমার লেখার বিষয় হতো না যদি গত ৯ এপ্রিলের দৈনিক ডেসটিনি সংবাদপত্রে নাগরিক সমাজের দু’জন সম্মানীয় ও পরিচিত নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি যারা কলাম লেখকও বটে, তাদের ছবিসহ মন্তব্য প্রতিবেদন প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা না হতো। শুধু এটাই নয়, বক্সের মধ্যে সেটা যেখানে ছাপা হয়েছে তারই বামপাশে ‘ডেসটিনি রিপোর্ট’ উল্লেখে সেটার লাল কালিতে মোটা মাপের শিরোনাম দেয়া ছিল। ওই সিদ্ধান্তটি আইনসিদ্ধ হয়েছে কি না সে বিষয়ে চটজলদি মন্তব্য করা উচিত হবে না। কারণ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেয়ার সুযোগ আছে এবং সে ক্ষেত্রে আদালতের রায়ই চূড়ান্ত হবে। সরকার কিংবা যে কোনো ব্যক্তি আইনি-বেআইনি কাজ জেনে বা না জেনে করতেই পারেনÑ সেটা নিষ্পত্তির জন্য আদালতই একমাত্র উপযুক্ত জায়গা এবং আইনের আশ্রয় নেয়া একমাত্র উপযুক্ত উপায়। আমি অবাক হয়েছি এই কারণে যে, তারা কেউই ওই কথাগুলো বলেননি। অথচ আইনের শাসনের অর্থই হচ্ছে সব বিরোধের নিষ্পত্তি হবে আইনের অনুসরণে এবং কখনো বলপ্রয়োগে নয়, যেটা হচ্ছে জঙ্গলের শাসন; যার রাশভারি নামটি হচ্ছে ফ্যাসিবাদ।
ঘটনাটি শুধু দৈনিক ডেসটিনি সংবাদপত্রেরই লিড নিউজ বা মুখ্য খবর ছিল না। দেশের সব ক’টি সংবাদপত্রেরই মুখ্য খবর ছিল, যাদের শিরোনাম ছিল মোটা মাপের লাল কালিতে ছাপা। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন দুঃখ করে লিখেছিলেনÑ ‘কিন্তু ভারতবর্ষের যে এক-তৃতীয়াংশ মানুষ রোজ রাতে ক্ষুধার জ্বালা নিয়ে ঘুমোতে যায়, যাদের গোটা জীবনটাই কাটে নিরবচ্ছিন্ন অনটনের মধ্যে আধপেটা খেয়ে, তাদের জন্য ত্রাণের কোনো ব্যবস্থা নেই। যে ক্ষুধা হঠাৎ বা চরম নয় কিন্তু সমাজ ব্যবস্থার মজ্জাগত, তার নীরব উপস্থিতি সংবাদপত্রে আলোড়ন তোলে না। তা নিয়ে রাজনৈতিক বিক্ষোভ হয় না, ভারতীয় সংসদ তার সম্পর্কে উত্তাল হয়ে ওঠে না। সমাজ ব্যবস্থার অঙ্গ হিসেবেই তা চলতে থাকে।’ প্রিয় পাঠক, উদ্ধৃতিতে যে দু’জায়গায় ‘ভারত’ উল্লেখ করা আছে, সে স্থলে ‘বাংলাদেশ’ যদি উল্লেখ করা যায়, তাহলে কিছুই হেরফের হবে না। অথচ নেতৃস্থানীয় সম্মানীয় দু’জন আলোচ্য ঘটনাটির কারণ হিসেবে প্রতিহিংসা উল্লেখ করলেন। একজন যখন তার কোনো স্বজনের হত্যাকারীর মৃত্যুদ- চান কিংবা তার সম্পত্তি থেকে জবরদখলকারীর উচ্ছেদ চান, তখন তার দাবিকে প্রতিহিংসা বলা হয় না। কারণ দাবিটি আইনের শাসন দ্বারা সমর্থিত। আবার অভিযুক্ত ব্যক্তি নিশ্চিত থাকেন এই কারণে যে, তিনি অভিযুক্তকারীর সমতুল্য আইনের আশ্রয় পাবেন। সুতরাং সরকারের উপরোক্ত সিদ্ধান্তটি কী কারণে আইনসিদ্ধ নয়, যদি তাদের ধারণায় থাকে সেটা কিংবা সেগুলো উল্লেখ না করে তাকে প্রতিহিংসাপরায়ণ কেন বলা হলো আমার বোধগম্য হয়নি। কোনো কাজকে প্রতিহিংসার ধুয়া তুলে বেআইনি বলা যায় না যতোক্ষণ না সে কাজটি আইনের নিক্তিতে ওজন করা হয়।
ইতিমধ্যে ফ্যাসিবাদের একটি সহজ সংজ্ঞা বলেছি। দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেল তার লেখা একটি পুস্তকে, যার শিরোনামের বঙ্গানুবাদ ‘স্মৃতির পট’ করা যায়, লিখেছেনÑ ‘সবমিলিয়ে একশ বছর আগের তুলনায় পৃথিবীতে এখন অল্পই স্বাধীনতা আছে।’ কেন? এ প্রশ্নটির উত্তর দিয়েছেন এমএন রায়Ñ ‘পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা ব্যক্তি মানুষকে একাকিত্বের পথে নিয়ে যায় এবং তার ফলে ব্যক্তি মানুষ সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। এই মারাত্মক নিঃসঙ্গতা থেকে ব্যক্তি মানুষকে উদ্ধার করতে গিয়ে ফ্যাসিবাদীরা রাষ্ট্রীয় একনায়কত্বের গুণগান করে এই উদ্দেশ্যে যাতে ব্যক্তি মানুষ আঁকড়ে ধরার জন্য একটা কিছু পায়। পুঁজিবাদী সমাজের এই নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ব্যক্তি মানুষ নিজের থেকেও বড় কিছুর ওপর নির্ভর করতে চায়। এই নির্ভরতার অšে¦ষণে ব্যক্তি মানুষ স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আশ্রয় খোঁজে। কিন্তু এই স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি মানুষকেই গ্রাস করে ফেলে।’ (দ্য প্রবলেম অফ ফ্রিডম বা স্বাধীনতার সমস্যা। অনুবাদ, শঙ্কর ঘোষ)।
প্রিয় পাঠক, বোধকরি আপনার কাছে এখন স্পষ্ট হয়েছে কেন আমরা সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হইচই, সমাবেশ ও মিছিল দেখছি। ব্যক্তি মানুষকে নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি দেয়ার উপায় বাংলাদেশের সংবিধানের স্থানীয় শাসনের রূপরেখায় দেয়া আছে। কিন্তু দুঃখের কথা, সেটা জনগণের ভাগ্যে আজতক জোটেনি। এ বিষয়ে অন্য সময় বলা হবে।
একটি ঐতিহাসিক ঘটনার কথা উল্লেখ করা যাক। তখন হযরত উসমানের খেলাফতের সময়। সিরিয়া প্রদেশটির গভর্নর ছিলেন মুয়াবিয়া। তিনি প্রদেশটির রাজধানী দামেস্ক শহরে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে একটা বিশাল প্রাসাদ নির্মাণ করছিলেন। হযরত আবুজর গিফারি ছিলেন একজন সাহাবি। সাহাবি একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ করা হয় যারা ইসলামের নবীর সাহচর্য পেয়েছিলেন। আবুজর প্রাসাদ নির্মাণস্থলে উপস্থিত হয়ে মুয়াবিয়াকে বললেন, ‘যদি তুমি রাষ্ট্রের অর্থে প্রাসাদ নির্মাণ কর, তবে তুমি একজন আত্মসাৎকারী। আর যদি তুমি নিজস্ব অর্থ দিয়ে নির্মাণ কর, তবে তুমি অপচয়কারী।’ অতঃপর আবুজর কোরআন থেকে আবৃত্তি করলেনÑ ‘যে অর্থ জমায় ও উহা বারবার গণনা করে; সে ধারণা করে যে, তাহার অর্থ তাহাকে অমর করিয়া রাখিবে, কখনো না, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হইবে। হুতামায়; হুতামা কী, তাহা তুমি কি জান? ইহা আল্লাহর প্রজ্বলিত হুতাশন, যাহা হৃদয়কে গ্রাস করিবে।’ (সুরা হুমাযা)। অতঃপর আবুজর সমবেত জনগণের উদ্দেশে কোরআন থেকে আবৃত্তি করলেন, ‘আর যাহারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, উহাদিগকে মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও। যেদিন জাহান্নামের অগ্নিতে উহা উত্তপ্ত করা হইবে এবং উহা দ্বারা তাহাদিগের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হইবে। সেদিন বলা হইবে, উহাই যাহা তোমরা নিজদিগের জন্য পুঞ্জীভূত করিতে।’ (সুরা তাওবা, আয়াত ৩৪-৩৫)। জনগণ আবুজরের কাছ থেকে এই শিক্ষা নিলেন যে, তৎকালে দামেস্ক শহরে পুঁজিবাদী বাসিন্দাদের দেখামাত্র জনগণ তাদের পিছু পিছু দৌড়াতে দৌড়াতে বলতে লাগলেনÑ ‘দাগি! দাগি!’ সঞ্চয় বিষয়ে কোরআনের অনুশাসন এইÑ “লোকে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, কী তাহারা ব্যয় করিবে? বলো, ‘যাহা উদ্বৃত্ত।’ এইভাবে আল্লাহ তাঁহার বিধান তোমাদের জন্য সুস্পষ্টরূপে ব্যক্ত করেন, যাহাতে তোমরা চিন্তা করো।” (সুরা বাকারা, আয়াত ২১৯)। কী প্রয়োজনের অতিরিক্ত? এটা আপনার মনের ওপর নির্ভর করে। আপনি যতোই উন্নত মনের অধিকারী হবেন, ততোই আপনি ব্যয়ে ও ভোগে মিতব্যয়ী হতে থাকবেন। ব্যক্তি মানুষের যুক্তিশীলতার পথে ক্রমাগত উত্তরণের এটি একটি প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের জাতীয় কবি অনেক আগেই যেটা লিখেছেনÑ ‘ওগো সঞ্চয়ী, উদ্বৃত্ত যা করিবে দান/ক্ষুধার অন্ন হোক তোমার।’
জোহান হারডার একজন জার্মান লেখক। ‘চিরন্তন বোঝা’ শিরোনামে তার লেখা একটি গল্পের সংক্ষেপিত অনুবাদ এই। একদা খলিফা হাক্কাম তার রাজপ্রাসাদের বাগান আরো বাড়ানোর জন্য আশপাশের জমি কিনতে লাগলেন। পাশে একজন গরিব লোকের বসতবাটি ছিল। সে কিছুতেই সেটা বেচবে না। হাক্কাম জমিটা জবরদখল করলেন। লোকটি জেলা বিচারকের কাছে নালিশ করলো। এ ক্ষেত্রে একজন খাঁটি বিচারক কী করবেন? তিনি একটি খচ্চরের পিঠে জিন লাগালেন, খচ্চরের গলায় মস্ত একটা থলে ঝুলিয়ে দিলেন এবং তারপর রাজবাগানের দিকে চললেন। ঘটনাচক্রে গরিব লোকটির জমিতে যেখানে সুন্দর গাছপালা লাগানো হয়েছে, খলিফা হাক্কাম সেখানে। তিনি বিচারককে ওভাবে আসতে দেখে অবাক হলেন। আরো অবাক হলেন যখন তাকে বিচারক বললেন, হুজুর, এই জমি থেকে মাটি নিয়ে ওই থলি ভরতে অনুমতি দিন। হাক্কাম অনুমতি দিলেন। থলি ভর্তি হলে হাক্কামকে বিচারক অনুরোধ করলেন, খচ্চরের পিঠে সেটা তুলে দেয়ার জন্য তাকে সাহায্য করতে। কিন্তু থলিটা তোলা গেল না। হাক্কাম বললেন, এটা খুব ভারি। তোলা কষ্ট। মৃদুস্বরে বিচারক বললেন, এটা খুব ভারি মনে হচ্ছে আপনার। কিন্তু গরিব লোকটির যে জমি আপনি বেআইনি ভোগ করছেন, থলিতে আছে তার মাত্র একটি সামান্য অংশ। তাহলে পুরো জমিটার ভার আপনি সইবেন কী করে, যখন শেষ বিচারের দিনে সবটা জমি আপনার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হবে।
প্রিয় পাঠক, এখন আজকের লেখাটির শিরোনামের কথা বলি। এটা রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘দুই বিঘা জমি’ নামের একটি কবিতার বাক্যের অংশ। পুরো বাক্যটি হচ্ছে:
‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি,/রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।’ কবিতাটি লেখার পেছনে একটি ঘটনা আছে। রবীন্দ্রনাথ তখন শিলাইদহে তার পৈতৃক কুঠিবাড়িতে আশপাশের জমিদারির দেখাশোনা করছেন। খবর পেলেন তার এক নায়েব একজন গরিব প্রজার জমি জোরদখল করেছে। মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ জমিদার রবীন্দ্রনাথের ঊর্ধ্বে উঠে ওই প্রতিবাদ-কবিতা তাৎক্ষণিক রচনা করলেন। তবে আমরা কেন মধ্যবিত্ত মানসিকতার ঊর্ধ্বে উঠে অতিরিক্ত সম্পত্তি ভোগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে পারবো না? বাংলাদেশের সংবিধানে তো এটা স্পষ্ট করাই আছে ২০(২) অনুচ্ছেদেÑ ‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসেবে কোন ব্যক্তি অনুর্পাজিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না…।’

No comments: